টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস

Spread the love

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস (Technical Analysis)  কি ?

ফরেক্স ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে “টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস”  হলো বাজারের পূর্ববর্তী সময়ের মূল্য এবং ভলিউমের ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে  ভবিষ্যত মূল্যের গতিবিধি অনুমান করার একটি গানিতিক পদ্ধতি। সহজ ভাষায়, প্রচলিত বিভিন্ন ধরণের চার্ট (যেমন: ক্যান্ডেলস্টিক চার্ট, লাইন চার্ট ইত্যাদি ) বিশ্লেষণ করে  এবং বিভিন্ন ধরনের  গাণিতিক সূচক (যেমন: moving average, RSI, MACD ইত্যাদি) ব্যবহার করে বাজারের গতিপ্রকৃতি  বা momentum, ওভারবট বা ওভারসোল্ড পরিস্থিতি এবং সম্ভাব্য বিপরীতমুখী গতিবিধি (reversals) চিহ্নিত করে মার্কেটের প্রবণতা বা ট্রেন্ড, সাপোর্ট (Support) এবং রেজিস্ট্যান্স (Resistance) , এবং  সম্ভাব্য এন্ট্রি ও এক্সিট পয়েন্ট চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া।

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস কিভাবে কাজ করে ?

  • ফরেক্স মার্কেটের টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস মূলত তিনটি মৌলিক ধারণার উপর ভিত্তি করে করা হয়। আর এই মৌলিক ধারণাগুলো এসেছে “ডাউ থিওরি” (Dow Theory) থেকে  যা আধুনিক টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের ভিত্তি স্থাপন করেছে । যেমন :
  1. বাজারের সকল তথ্য ডিসকাউন্ট করে :
    • The Market Discounts Everything  এই ধারণার মানে হলো, একটি নির্দিষ্ট ট্রেডিং পেয়ারের (যেমন: একটি মুদ্রা জোড়া) বর্তমান মূল্যের মধ্যে সেই ট্রেডিং পেয়ার সম্পর্কিত সমস্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য (অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কোম্পানির খবর, বাজারের চাহিদা-যোগান ইত্যাদি) ইতিমধ্যে অন্তর্ভুক্ত  হয়েছে বা প্রতিফলিত হয়ে গেছে।
    • টেকনিক্যাল অ্যানালিস্টরা বিশ্বাস করেন যে, বাজারের বাইরে থেকে নতুন কোনো তথ্য খোঁজার দরকার নেই, কারণ সেই  সকল তথ্য ইতিমধ্যেই মূল্যের উপর প্রভাব ফেলেছে এবং চার্টের মধ্যে সেটার প্রতিফলিত হয়েছে । তাই, তারা বাজারের বাইরের কোনো খবর বা ঘটনার দিকে মনোযোগ না দিয়ে সরাসরি মূল্য চার্ট এবং ভলিউম বিশ্লেষণ করেন।
  2. মূল্য প্রবণতায় চলা (Prices Move in Trends):
    • বাজারের মূল্য এলোমেলোভাবে ওঠানামা করে না; বরং একটি মূল্য নির্দিষ্ট প্রবণতা (Trend) অনুসরণ করে চলে। এই প্রবণতা তিন প্রকারের হতে পারে:
      • আপট্রেন্ড (Uptrend): যখন মূল্য ক্রমান্বয়ে উচ্চতর উচ্চ (Higher Highs) এবং উচ্চতর নিম্ন (Higher Lows) তৈরি করে। অর্থাৎ, দাম বাড়তে থাকে।
      • ডাউনট্রেন্ড (Downtrend): যখন মূল্য ক্রমান্বয়ে নিম্নতর নিম্ন (Lower Lows) এবং নিম্নতর উচ্চ (Lower Highs) তৈরি করে। অর্থাৎ, দাম কমতে থাকে।
      • সাইডওয়েজ/রেঞ্জ (Sideways/Range): কোনো সুস্পষ্ট ঊর্ধ্বমুখী বা নিম্নমুখী প্রবণতা ছাড়াই যখন মূল্য একটি নির্দিষ্ট সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স স্তরের মধ্যে ওঠানামা করে, ।
    • টেকনিক্যাল অ্যানালিস্টদের লক্ষ্য হলো এই প্রবণতাগুলো যত দ্রুত সম্ভব চিহ্নিত করা এবং  The trend is your friend  এই বিশ্বাসে  মার্কেট ট্রেন্ড অনুসরন করে ট্রেড করা।
  3. ইতিহাস পুনরাবৃত্তি করে (History Repeats Itself):
    • এই ধারণাটি মানুষের মনোবিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে তৈরি। ট্রেডাররা বিশ্বাস করেন যে, অতীতের মূল্য প্যাটার্ন এবং প্রবণতাগুলো ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কারণ বাজারের অংশগ্রহণকারীদের আচরণ (যেমন: ভয়, লোভ, অনিশ্চয়তা) সময়ের সাথে সাথে খুব বেশি পরিবর্তিত হয় না।
    • যখন একই ধরনের প্যাটার্ন অতীতে একটি নির্দিষ্ট ফলাফল এনেছে, তখন ভবিষ্যতে একই প্যাটার্ন দেখা গেলে ট্রেডাররা একই ধরনের ফলাফলের আশা করেন। এই কারণে, টেকনিক্যাল অ্যানালিস্টরা বিভিন্ন চার্ট প্যাটার্ন (যেমন: হেড অ্যান্ড শোল্ডারস, ডাবল টপ, ট্রায়াঙ্গেল) এবং ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন (যেমন: হ্যামার, এনগাল্ফিং) ব্যবহার করে ভবিষ্যতের মূল্য গতিবিধি অনুমান করার চেষ্টা করেন।

         উপরেরর এই তিনটি মৌলিক ধারণার উপর ভিত্তি করে টেকনিক্যাল অ্যানালিস্টরা বিভিন্ন টুলস এবং   কৌশল (যেমন:

ইন্ডিকেটর, সাপোর্ট/রেজিস্ট্যান্স, ট্রেন্ড লাইন, চার্ট প্যাটার্ন ব্যবহার করে  বাজারের গতিবিধি বিশ্লেষণ করেন এবং ট্রেডিং

সিদ্ধান্ত নেন।

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে ট্রেডাররা মূলত চারটি জিনিস চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন:

  • সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স (Support and Resistance): সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স  এমন

একটিমূল্য স্তর যেখানে বাজারের গতি প্রায়শই পরিবর্তিত হয়। সাপোর্ট  হলো এমন একটি মূল্য স্তর  যেখানে দামের পতন সাধারণত থেমে যায় এবং বিপরীতমুখী হয়, আর রেজিস্ট্যান্স  হলো এমন একটি মূল্য স্তর যেখানে দামের বৃদ্ধি সাধারণত থেমে যায় এবং বিপরীতমুখী হয়।

  • প্রবণতা (Trends): মার্কেট  আপট্রেন্ড (দাম বৃদ্ধির প্রবনতা), ডাউনট্রেন্ড (দাম হ্রাসের প্রবনতা) বা রেঞ্জ (দাম একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করছে) হতে পারে। টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস এর মাধ্যমে মার্কেটের এই প্রবণতাগুলো চিহ্নিত করা যায়।
  • রেঞ্জ (Ranges): যখন বাজার একটি নির্দিষ্ট সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স স্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তখন তাকে রেঞ্জ বা সাইডওয়েজ মার্কেট বলে।
  • প্রবেশ এবং প্রস্থান পয়েন্ট (Entry and Exit Points): টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের সবচেয়ে বড সুবিধা হলো যে, ফরেক্স মার্কেটে ঠিক কখন একটি ট্রেডে প্রবেশ করা উচিত (Buy or sell ) এবং কখন  trade close করা উচিত ।

জনপ্রিয় কিছু ফরেক্স টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস টুলস এবং কৌশল:

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের জন্য  বিভিন্ন টুলস এবং কৌশল ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে কিছু জনপ্রিয় উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:

  1. চার্ট প্যাটার্ন (Chart Patterns):
    • ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন (Candlestick Patterns): বিভিন্ন ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন (যেমন: ডজি, হ্যামার, ইনভার্টেড হ্যামার, এনগাল্ফিং প্যাটার্ন, ইত্যাদি) বাজারের সম্ভাব্য বিপরীতমুখী গতি বা চলমান প্রবণতা অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত প্রদান করে।
    • ট্রায়াঙ্গেল, ফ্ল্যাগ ও  প্যানেন্ট (Triangles, Flags and Pennants): এই তিনটি হলো ধারাবাহিক প্যাটার্ন যা মার্কেটের চলমান ট্রেন্ড অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত দেয়।
    • হেড অ্যান্ড শোল্ডারস (Head and Shoulders): এটি একটি রিভার্সাল প্যাটার্ন যা সাধারণত একটি প্রবণতা শেষ হওয়ার এবং বিপরীতমুখী প্রবনতা বা ট্রেন্ড শুরুর  ইঙ্গিত দেয়।
  2. টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর (Technical Indicators):
    • মুভিং এভারেজ (Moving Average – MA): এটি নির্দিষ্ট সময়ের গড় মূল্য প্রদর্শন করে, যা মার্কেটের ট্রেন্ড শনাক্ত করতে এবং সাপোর্ট ও রেজিস্ট্যান্স  চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
    • MACD (Moving Average Convergence Divergence): এটি দুটি মুভিং এভারেজের মধ্যে সম্পর্ক দেখায় এবং বাজারের গতি (Momentum) এবং সম্ভাব্য বিপরীতমুখী গতি চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
    • RSI (Relative Strength Index): এটি একটি ওভারবট (Overbought) বা ওভারসোল্ড (Oversold) পরিস্থিতি চিহ্নিত করতে সাহায্য করে, যা বাজারের সম্ভাব্য বিপরীতমুখী গতির ইঙ্গিত দিতে পারে।
    • বোলিঞ্জার ব্যান্ডস (Bollinger Bands): এটি বাজারের অস্থিরতা (Volatility) পরিমাপ করে এবং সম্ভাব্য ওভারবট/ওভারসোল্ড পরিস্থিতি চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
    • স্টকাস্টিক অসসিলেটর (Stochastic Oscillator): এটিও RSI এর মতো ওভারবট/ওভারসোল্ড পরিস্থিতি চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হয়।
    • ফিবোনাক্কি রিট্রেসমেন্ট (Fibonacci Retracement): এটি ভবিষ্যতের সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স স্তরগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
  3. সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স লাইন (Support and Resistance Lines):
    • চার্টে পূর্ববর্তী উচ্চ এবং নিম্ন মূল্য পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করে এই লাইনগুলো আঁকা হয়। এগুলো সাধারণত বাজারের সম্ভাব্য টার্নিং পয়েন্ট নির্দেশ করে।
  4. ট্রেন্ড লাইন (Trend Lines):
    • মূল্য চার্টে ধারাবাহিক উচ্চ বা নিচ পয়েন্টগুলো যুক্ত করে এই লাইনগুলো আঁকা হয়, যা বাজারের প্রবণতা নির্দেশ করে।

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা:

  • শুধু টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অনেক ট্রেডার ফান্ডামেন্টাল অ্যানালাইসিসের (অর্থনৈতিক তথ্য এবং বাজারের খবর বিশ্লেষণ) সাথে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসকে একত্রিত করে আরও ভালো ট্রেডিং সিদ্ধান্ত নেন।
  • কোনো অ্যানালাইসিস পদ্ধতিই 100% নির্ভরযোগ্য নয়। ফরেক্স বাজারে সবসময় অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে-ই পারে।
  • ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা (Risk Management) ফরেক্স ট্রেডিংয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস শুধু সম্ভাব্য সুযোগগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করে, কিন্তু লাভ নিশ্চিত করে না।

পরিশেষে, ফরেক্স টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস হলো একটি টুলকিট যা ট্রেডারদেরকে বাজারের অতীতের আচরণ বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলো সম্পর্কে ধারণা পেতে সাহায্য করে, যাতে তারা আরও ভালো ট্রেডিং সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটি ফান্ডামেন্টাল অ্যানালাইসিসের (অর্থনৈতিক তথ্যের বিশ্লেষণ) পরিপূরক হিসেবে কাজ করে এবং অনেক ফরেক্স ট্রেডারের জন্য এটি একটি অপরিহার্য কৌশল।

তবে, এটাও মনে রাখা জরুরি যে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস একটি সম্ভাবনার বিজ্ঞান, ১০০% নিশ্চিত কিছু নয়। এটি বাজারের সমস্ত তথ্যকে ডিসকাউন্ট করলেও, অপ্রত্যাশিত বৈশ্বিক ঘটনা বা বড় ফান্ডামেন্টাল পরিবর্তন অনেক সময় টেকনিক্যাল প্যাটার্ন ভেঙে দিতে পারে। তাই অভিজ্ঞ ট্রেডাররা প্রায়শই ফান্ডামেন্টাল এবং টেকনিক্যাল উভয় বিশ্লেষণকেই একত্রিত করে ব্যবহার করেন।

ফরেক্স টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস শেখা এবং অনুশীলন করার জন্য ডেমো অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা, শিক্ষামূলক উপকরণ পড়া এবং অভিজ্ঞ ট্রেডারদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া খুবই সহায়ক হতে পারে।

Scroll to Top